কোরবানীর চামড়ার বিপর্যয়, এতিমের পেটে লাথি
প্রকাশ: ২০১৯-০৮-১৯ ১৬:৪৫:১৮ || আপডেট: ২০১৯-০৮-১৯ ১৬:৪৫:১৮

এবারের কোরবানীর পশুর চামড়ার দর পতন স্বাধীনতার পর অর্থনীতিতে মারাত্মক বিপর্যয়। দেশে কয়েক কোটি ধর্মপ্রাণ মুসলমান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে পশু কোরবানী করেছে। পশু কোরবানীর চামড়া জাতীয় অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখে। চামড়া, পাট এটা জাতীয় সম্পদ। পশুর চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে মূল্যবান ব্যাগ, জুতা সহ বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রী তৈরী করা হয়। চামড়া রপ্তানী করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হয়। কোরবানীর পশুর চামড়া মুসলিম রাষ্ট্রের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে একটি বিরাট মাধ্যম।
বিগত কয়েক বছর যাবত সরকারের সঠিক পদক্ষেপের অভাবে চামড়া শিল্পের মারাত্মক দর পতন অব্যাহত আছে। সঠিক কি কারণে চামড়া শিল্পের এতো বড় বিপর্যয় এবং জাতীয় অর্থনীতির বিরাট ঘাটতি বুঝে আসছে না। তবে এ কথা পরিষ্কার দেশি বিদেশি একটি মহল এ শিল্পকে ধ্বংস করে দেশের বাইরে পাচার করার চক্রান্ত ছাড়া অন্য কিছু দেখছি না। সে যে ধরনেরই ষড়যন্ত্র আর চক্রান্ত হোক না কেন সরকারের অগোচরে কোনো ষড়যন্ত্র কখনো সফল হতে পারে না। তাহলে কেন সরকার এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে আগে থেকে উদ্যোগ নেয় নি। সরকারের নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয় রয়েছে। আছে বিভিন্ন সংস্থা, গোয়েন্দা নজরদারি। এতোসব কিছুর মাঝে শত শত কোটি টাকার সম্পদ কিভাবে দর পতনের মাধ্যমে ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হলো সে জায়গায় সচেতন মহলের অনেক প্রশ্ন।
মূলত এ চামড়ার মূল্যের টাকাগুলো হতদরিদ্র, এতিম, মিসকিনদের পেটে যায়। তারা তো আর চামড়া খায় না, চামড়ার বিক্রয়লব্দ অর্থ দু:স্থ অনাথ আশ্রয়কেন্দ্রে দেয়া হয়। এ অর্থের মাধ্যমে অসহায় শিশুরা বেড়ে উঠে। তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়। এ শিল্পকে পর্যায়ক্রমে ধ্বংসের মাধ্যমে অসহায় দু:স্থদের পেটে আঘাত করা হয়েছে।
জাতীয় অর্থনীতির বিরাট একটি খাত চামড়া শিল্প। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম নিয়মিত মাধ্যম। এখন হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে এ মুদ্রা অর্জন। এ শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের লাখ লাখ টাকার অপচয় হয়েছে, তাদের কপালে ভাজ পড়েছে। অন্যদিকে চামড়া খাতে প্রতিষ্টিত শিল্প কারখানার শত শত শ্রমিক মালিক চরমভাবে হতাশা আর ভোগান্তির মধ্যে। অনেক চামড়া শিল্পের মালিক ব্যাংক ঋণের চাপে পড়ে ব্যবসা বন্ধ করার উপক্রম। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শিল্প ব্যবসা ধান, পাট ও চামড়া।
ধান, পাট শিল্প ক্রমেই ধ্বংসের পথে। বর্তমানে অব্যাহত গতিতে চামড়া শিল্পকে ধ্বংস করা হচ্ছে। এসব কীসের লক্ষণ নি:সন্দেহে রাষ্ট্রকে খুঁজে বের করতে হবে। একটি রাষ্ট্র অর্থনৈতিক শৃঙ্খলায় রাখতে হলে রাষ্ট্রের ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্প কারখানা একেবারে সবগুলো খুঁটিনাটি বিষয় রাষ্ট্রকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। নাগরিকের ব্যবসা বাণিজ্য, লাভ ও অলাভ রাষ্ট্রকে চিন্তা করতে হবে। সুবিধা আর অসুবিধায় সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়ে জনগণকে পরিচালনার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের। এ খাতে ধারাবাহিক বিপর্যয় কয়েক বছর থেকে লেগেই আছে। রাষ্ট্র কেন জনগণের মঙ্গলে এগিয়ে এলো না সেখানেই অনেক কথা। জনগণের সরকার রাষ্ট্র যথা সময়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে কোনো অবস্থায় এতো বড় বিপর্যয়ের মুখে এ শিল্পকে পড়তে হতো না। এখন লাখ লাখ পশুর চামড়া ক্রয় বিক্রয় না হওয়ায় জাতীয়ভাবে যে ক্ষতি হয়েছে এর দায়িত্ব কে নেবে? যারা ক্ষুদ্র প্রান্তিক ব্যবসায়ী মৌসুমি ব্যবসার মাধ্যমে বিনিয়োগ করেছে তাদের ক্ষতি কে পুষিয়ে দেবে? এসব প্রশ্নের উত্তর ক্ষমতাসীনদের দেয়া চায়।
পাশ্ববর্তী দেশে বাংলাদেশের চেয়ে ৩-৪ গুণ বেশি দামে চামড়ার ক্রয় বিক্রয় হয়ে থাকলেও বাংলাদেশে কেন তার বিপরীত সেটার পেছনে মূলে কি রহস্য সেটা উদঘাটন করতে হবে। বাংলাদেশকে যারা শিল্প সংস্কৃতি ব্যবসায় পিছনে ফেলে রাখতে চায়, সেসব চক্রান্ত এখনো অব্যাহত আছে। তাদের ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। এসব চক্রান্তের ওপর দৃষ্টি রাখতে না পারলে একসময় দেশের সবগুলো শিল্প কারখানা বন্ধ হওয়ার পথে ধাবিত হবে। ঐতিহ্যবাহী যেসকল ব্যবসা বাণিজ্য ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সেক্টর রয়েছে সেগুলো সচল ও অব্যাহত রাখার চেষ্টা থাকতে হবে।
বাংলাদেশে কৃষিবান্ধব দেশ। কৃষিপণ্য উৎপাদন ও রপ্তানীতে সঠিক কর্মপরিকল্পনা থাকতে হবে। কৃষক, দিনমজুর, শ্রমিক জনগণকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এদেশে সংখ্যাগরিস্ট নাগরিক মুসলমান। ফলে তাদের ধর্মীয় অনুষ্টানে পশুর ব্যবহার ও চাহিদা রয়েছে। পশুর চামড়ার একটা বিরাট বাজার এদেশ। এটাকে কখনো নিরুৎসাহিত ও সংকুচিত করা যাবে না। যেহেতু ধর্মীয়ভাবে পশু কোরবানী দেয়ার মতো একটা সংস্কৃতি মুসলমানদের মধ্যে বিরাজমান, সেহেতু এখানে পশুর চামড়ার বিরাট একটি বাজার থাকা স্বাভাবিক। ফলে এদেশ ও সরকারের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বিরাট একটি সুযোগ। তাই এ খাতকে কোনো অবস্থায় দুর্বল করে ভাবা সমুচিত হবে না। এখন থেকে আগামীর জন্য রাষ্ট্রকে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের মতামত গ্রহণ করে সঠিক পন্থায় রাষ্ট্রকে চামড়া খাতকে সচল রাখতে হবে। এবারের মতো চামড়ার নজিরবিহীন বিপর্যয় জনগণ আর দেখতে চায় না। কোনো অবস্থায় সরকার এর দায় দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না। এ শিল্পের বিপর্যয়ের জন্য সরকারকে জনগণের সামনে জবাব দিতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত আর যারা এতিমের পেটে লাথি মেরেছে তাদের সঠিক চেহারা খঁজে বের করতে হবে। সম্পদ আর অর্থের মারাত্মক অপচয় কোনো অবস্থায় জনগণ মেনে নিতে পারছে না। এ বিপর্যয়ের সঠিকভাবে কারণ নির্ণয় ও উদঘাটন করে আগামী দিনের বাস্তব পরিকল্পনা গ্রহণ চায় জনগণ। যেকোনো মূল্যে চামড়া শিল্পের উজ্জ্বল অতীত ফিরিয়ে এনে জাতীয় অর্থনীতির সফলতা প্রতিষ্টা করতে হবে।
লেখক: মাহমুদুল হক আনসারী
গবেষক, প্রাবন্ধিক।
ট্যাগ :
© 2016 - All Rights Reversed dailyctgnews
Web Developed by Ctgtimes (Pvt.) Limited